আরফাতুল মজিদ, কক্সবাজার :: পর্যটন এলাকা কক্সবাজার শহরের ত্রাস হিসেবে গত আট বছর আগেই সূচনা হয় আশিকুর ইসলাম ওরফে আশিকের। ২০১২ সালের দিকে ছিনতাইকারী হিসেবে পুলিশের খাতায় নাম উঠে আশিকের। এরপর থেকে একের পর এক ছিনতাই, চাঁদাবাজি, হোটেল দখল, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ে নেমে পড়ে এই ছিনতাইকারী। ভারী হতে থাকে আশিকের গ্রুপ। বর্তমানে কক্সবাজারের ভয়ঙ্কর গ্রুপ হিসেবে বেশ পরিচিত আশিকের দলটি। তার গ্রুপে রয়েছে শীর্ষ ১০ জন অপরাধী। যাদের বিরুদ্ধে ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ ও মাদকের অভিযোগ ও মামলা রয়েছে। আশিক গ্রুপের অনেক সদস্য বিভিন্ন মামলায় কারাগারেও গিয়েছিল। কারাগার থেকে বের হয়ে একই দলে যোগ দেন তারা। দল বেধে মোটর সাইকেল যোগে গভীররাতে হোটেল মোটেল জোন এলাকায় তাদের বিচরণ। গোয়েন্দা সংস্থার একটি দপ্তরেও আশিক গ্যাংদের বিষয়ে তথ্য রয়েছে।
অনুসন্ধানে ও পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে- আশিকুর ইসলাম কক্সবাজার শহরের বাহারছড়া এলাকার মৃত করিমের ছেলে। তার বিরুদ্ধে প্রায় ১৭টি মামলা রয়েছে। এতিমধ্যে ৫ বার আটকও হয়েছিল আশিক। কিন্তু থেমে থাকেনি তার অপকর্ম। তার সাথে রয়েছে ই¯্ররাফিল হুদ জয়া। জয়া বাহারছড়া এলাকার সন্ত্রাসী শফির ছেলে। শফি শহরের নাম্বার ওয়ান সন্ত্রাসী হিসেবে বেশ পরিচিত ছিল। আশিকের সাথে জয়াও বেশ কয়েকবার আটক হয়েছিল। তার সাথে রয়েছে মেহেদী হাসান বাবু ওরফে গুন্ডিয়া। বাবু বাহারছড়া এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে। আবুল কাশেম ঝাউতলা এলাকার হোটেল সাগর গাঁও এর নাইট গার্ড।
সন্ত্রাসী আশিকের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে রয়েছে বাহারছড়া এলাকার আসমত আলীর ছেলে মোবারক আলী। মোবারকের বিরুদ্ধেও রয়েছে পাঁচটির অধিক মামলার। এসব মামলায় আটক হয়ে কারাগারে গিয়েছিল ৪ বারের অধিক। তবে সন্ত্রাসী আশিকের উত্থান মোবারকের হাত ধরেই। মোবারকের হাত ধরে আশিকের উত্থান হলেও অপর্কমে মোবারকে ছাড়িয়ে গেছে আশিক। এছাড়া মোবারকের অস্ত্রের যোগানদাতা হিসেবে রয়েছে শহরের শিবির ক্যাডার সালাউদ্দিন। সালা উদ্দিনের কাছ থেকে নিয়মিত অস্ত্র কিনত মোবারক।
আশিক বাহিনীর অন্যতম অর্থযোগানদাতা হিসেবে রয়েছে কক্সবাজার বাস টার্মিনাল এলাকার আবুল কালাম ওরফে বড় দা। আবুল কালাম কক্সবাজার শহরের র্শীষ ইয়াবা কারবারি হিসেবে পরিচিত। বড় দা’র বাড়ি এক সময় টেকনাফ থাকলেও বর্তমানে কক্সবাজারে বসবাস। টেকনাফে একব্যক্তিকে হত্যার পর কক্সবাজারে পালিয়ে আসে আবুল কালামের পুরো পরিবার। কক্সবাজারে বসে টেকনাফের ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ করে তিনি। তার বিরুদ্ধে মাদকের মামলাও রয়েছে। এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারিও আবুল কালাম।
আশিকের ছিনতাইকারী পার্টনার হিসেবে রয়েছে বাহারছড়া এলাকার জোবাইর। এমনকি আশিকের ইয়াবা পৌঁছে দেন জোবাইর। এছাড়া আশিকের সহযোগি হিসেবে রয়েছে বাহারছড়া এলাকার বিজয় দাশ ও ইরফান। ইরফান এলাকায় খুচরা ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ পরিচিত। একই সাথে বিজয় দাশও আশিকের ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। দীর্ঘদিন ধরে আশিক ও মোবারকের সহযোগি হিসেবে রয়েছে বাহারছড়া এলাকার আরিফুল ইসলাম ওরফে ছোট আরিফ।
আশিক গ্রুপের এসব অপকর্ম ও ইয়াবা কারবারের অর্থযোগান দাতা হিসেবে রয়েছে শহরের গাড়ির মাঠ এলাকার নুর নবী শাহিন। শাহিন শহরের রহস্যজনক হিসেবে চিহ্নিত। তার দৃশ্যমান কোন কিছুই না থাকলে জীবন-যাপন আলিশান। শাহিনের স্থায়ী বাড়ি টেকনাফের হ্নীলা রঙ্গিখালী এলাকায়। দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার শহরে অবস্থান করে জীবন-যাপন করছে কোটিপতি স্টাইলে। তবে বেশির ভাগ আশিক ও মোবারকের ছবিতে দেখা যায় শাহিনকে।
একটি সূত্রে জানা গেছে- কক্সবাজার শহরে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ড চালিয়ে আশিকসহ তার সহযোগিরা আশ্রয় নিত পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড সমিতি পাড়া এলাকার আজিজুল হক আরজুর বাড়িতে। আরজু সমিতি পাড়াস্থ ফদনার ডেইল এলাকার হাসিম মাঝির ছেলে। আরজুরও একজন চিহ্নিত মাদক কারবারি। ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে আটকও হয়েছিল আশিকের সহযোগি আরজু।
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানিয়েছে- সন্ত্রাসী আশিকুল ইসলামের এই বেপরোয়া জীবন-যাপনের পিছনে হাত রয়েছে রাসেল নামে একব্যক্তির। শহরের বিভিন্ন অপর্কমে তদবির করে আশিককে ছাড়িয়ে নিত রাসেল। এমন অনেক তথ্যও রয়েছে আশিককে ছাড়িয়ে নিতে রাসেলের বিরুদ্ধে। এছাড়া গাড়ির মাঠ এলাকার সাত্তার ও রোজিনা নামে এক দম্পত্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে আশিককে আশ্রয়দাতা হিসেবে। সাত্তার ও রোজিনাও চিহ্নিত মাদক কারবারি। যার কারণে আশিকের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সর্ম্পক রয়েছে। গত ১৫দিন আগে আশিককে জামিনে বের করে আনেন সাত্তার ও রোজিনা।
কক্সবাজারের এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন- ধর্ষণের ঘটনায় আশিকের তথ্য খুঁজতে গিয়ে ভয়ঙ্কর অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। তার অপরাধের শেকড় যে কত গভীরে তা বলার ভাষা নেই। সব চিহ্নিত অপরাধীর সাথে তার যোগাযোগ। রয়েছে নিজস্ব বাহিনীও। যারা চিহ্নিত ছিনতাইকারী, মাদক কারবারি ও দখলবাজ। এমনকি কলাতলীর মোড়ে একটি হোটেল দখলে নেন আশিক বাহিনী। যে হোটেল থেকে জেলা ছাত্রলীগের এক নেতার মাধ্যমে ৬ লাখ টাকা নেন আশিক ও তার সহযোগিরা। এছাড়া কটেজ জোনে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ আশিকের পুরো বাহিনীর বিরুদ্ধে। আশিকসহ তার সকল চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের নজরদারীতে রাখা হয়েছে।
এবিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন- এক নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় ইতিমধ্যে আশিকসহ তার তিনসহযোগির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। একই সাথে আশিকের গ্রুপে যেসব অপরাধী রয়েছে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। দ্রুত সময়ে সকল অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা হবে।
র্যাব জানিয়েছে- অন্ধকার জগতের এমন কোনো দিক নেই যেখানে আশিকের বিচরণ নেই। ব্লাইমেইলের মাধ্যমে পর্যটকদের জিম্মি করে টাকা হাতিয়ে নেওয়াই ছিল আশিকুল ইসলাম আশিকের অন্যতম পেশা। স্থানীয় লাইট হাউজে বসে এসব কাজ চালাতেন তিনি। এছাড়া স্থানীয় মাদক ব্যবসা, অস্ত্র কারবার ছাড়াও চুরি ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এসব অভিযোগে বিভিন্ন সময় তার বিরুদ্ধে ১২টি মামলা হয়। এসব মামলায় পাঁচবার গ্রেপ্তারও হন।
২০১১ সালে এসএসসি পাসের পর বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িত ছিলেন আশিক। এছাড়া নিজে গ্যাং বাহিনী খুলে শহরের সুগন্ধা এলাকায় ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট জোর করে কম টাকায় ভাড়া নিয়ে দ্বিগুণ ও তিনগুণ দামে ভাড়া আদায় করতেন। তাছাড়া ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি অবৈধভাবে দখল করে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
র্যাব আরও জানায়, গ্রেপ্তার আশিক কক্সবাজারে পর্যটক এলাকায় একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের মূলহোতা। এই চক্রের সদস্য সংখ্যা ৩০-৩৫ জন। আশিক বিগত ২০১২ বছর থেকে কক্সবাজার পর্যটক এলাকায় বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। প্রথম ২০১৪ সালে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয় পুলিশের হাতে। তার সিন্ডিকেট পর্যটন এলাকা কক্সবাজারে চুরি, ছিনতাই, অপহরণ, জিম্মি, চাঁদাবাজি, জবরদখল, ডাকাতি ও মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরণের অপরাধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। পর্যটন এলাকায় বিভিন্ন হোটেলে ম্যানেজারের সঙ্গে যোগসাজসে ট্যুরিস্টদের ফাঁদে ফেলে ব্লাকমেইল করতো।
পাঠকের মতামত: